আপনি কি জানেন, আমরা চাইলেই লক্ষ লক্ষ ডলার বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যাওয়া বন্ধ করতে পারি। ২০১৭ সালের একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক পেমেন্ট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো (যেমন ভিসা, মাস্টারকার্ড এবং আমেরিকান এক্সপ্রেস) ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশের কার্ড লেনদেন থেকে প্রায় ৩৭ কোটি টাকা ফি বা চার্জ হিসেবে আয় করেছে। এটি আজ থেকে ৯ বছর আগের হিসাব। ২০২৫ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের (BB) তথ্য অনুযায়ী, দেশে কার্ডভিত্তিক লেনদেন গত পাঁচ বছরে ২২৮% বৃদ্ধি পেয়েছে, ২০২৫ এপ্রিল নাগাদ তা দাঁড়িয়েছে ৪১,৪০৭ কোটি টাকা, যেখানে পাঁচ বছর আগে ছিল ১২,৬৪৩ কোটি টাকা।
কার্ড লেনদেনে ফান্ড মুভমেন্ট কীভাবে হয় আমি একটি গল্পের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করব
১: রাসিফ (গ্রাহক / কার্ডধারী) দোকান থেকে ১,০০০ টাকা মূল্যের পণ্য কেনে।
২: এরপর Issuer Bank (কার্ডধারীর ব্যাংক) Clearing & Settlement ধাপে, Issuer Bank রাসিফের একাউন্ট থেকে ১,০০০ টাকা কেটে নেয়। অতঃপর ব্যাংক তার Interchange Fee (১৬ টাকা) কেটে রাখে এবং বাকি ৯৮৪ টাকা পাঠিয়ে দেয় Card Network এর কাছে।
৩: Card Network (Visa / Mastercard / Amex / Discover) Issuer ও Acquirer এর মাঝে সংযোগকারী সেতু। তারা ৯৮৪ টাকা থেকে ১ টাকা Network Fee রেখে দেয়। তারপর ৯৮৩ টাকা পাঠিয়ে দেয় Acquirer Bank এর কাছে।
৪: Acquirer / Payment Gateway (Merchant-এর ব্যাংক) ৯৮৩ টাকা গ্রহণ করে। এখান থেকে তারা তাদের Processing Fee বা MDR (৩ টাকা) রেখে দেয়। বাকি ৯৮০ টাকা মার্চেন্টের একাউন্টে জমা করে।
৫: সবশেষে মার্চেন্ট তার একাউন্টে ৯৮০ টাকা পান, যদিও কাস্টমার খরচ করেছিলেন ১,০০০ টাকা। অর্থাৎ পুরো প্রক্রিয়ায় (Issuer + Network + Acquirer ফি) মোট খরচ = ২০ টাকা।
বিঃদঃ উপরের টাকার সংখ্যা গুলো বুঝানোর দেওয়া। বাস্তবে কম বেশি হবে।

বিস্তারিত জানতে খান একাডেমির এই ভিডিও দেখতে পারেন : https://www.youtube.com/watch?v=IPxQQNyCxas
উপরের প্রতিকী গল্প থেকে বু্ঝা যায় ১০০০ টাকার লেনদেনে, কার্ড নেটওয়ার্ক ১ টাকা পাচ্ছে। আসল হিসাব হল আন্তর্জাতিক পেমেন্ট সার্ভিসগুলো POS মেশিনে প্রতিটি ক্রেডিট কার্ড লেনদেনে ০.৩% এবং ডেবিট কার্ড লেনদেনে ০.১% হারে চার্জ নেয়। ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে অনলাইন লেনদেনের ক্ষেত্রে এই হার আরও বেশি — ক্রেডিট কার্ডে ০.৭% এবং ডেবিট কার্ডে ০.৩%। এছাড়া প্রতিটি আর্থিক লেনদেনে চার্জ ছাড়াও, ভিসা, মাস্টারকার্ড ও অ্যামেক্স সার্টিফিকেশন পেতে এবং বার্ষিক নবায়নের জন্যও ব্যাংকগুলোকে আলাদা ফি পরিশোধ করতে হয়। এ থেকে অনুমান করা যায়, কত লক্ষ লক্ষ ডলার বাংলাদেশ থেকে বিদেশে চলে যাচ্ছে।
এখন এর প্রতিকার হল বাংলাদেশের লোকাল স্কিমের কার্ড (TakaPay), বাংলা QR সার্ভিস এবং লোকাল MFS (বিকাশ, নগদ, রকেট ইত্যাদি) ব্যাবহার করা। টাকাপে (TakaPay) হলো বাংলাদেশের জাতীয় কার্ড স্কিম, যা তৈরি করা হয়েছে ভিসা ও মাস্টারকার্ডের মতো আন্তর্জাতিক পেমেন্ট সিস্টেমের উপর নির্ভরতা কমাতে, বিদেশি মুদ্রা সাশ্রয় করতে, এবং লেনদেন ব্যয় হ্রাস করতে। এটি ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ বাংলাদেশ (NPSB)-এর অধীনে পরিচালিত একটি লোকাল ডেবিট কার্ড। অন্যান্য দেশেও একই ধরনের নিজস্ব কার্ড স্কিম রয়েছে, যেমন শ্রীলঙ্কাতে LankaPay,
পাকিস্তানে PakPay, ভারতে RuPay, এবং সৌদি আরবে Mada।
তবে বাস্তবতা হল, TakaPay বা বাংলা QR এর ব্যবহার খুব একটা দেখা যায় না। কারন TakaPay সীমিত ফিচার ও ব্যাংক ইন্টিগ্রেশন শুরু হয়েছিল এবং পূর্ণমাত্রার রোলআউট খুব ধীরে হয়েছে। ফলে এটি নিয়ে একটি ধারণা তৈরি হয়েছে যে, ভিসা বা মাস্টারকার্ডের মতো আন্তর্জাতিক স্কিমগুলোর তুলনায় দুর্বল।
এছাড়া কোনো নতুন সেবা জনপ্রিয় করতে হলে আকর্ষণীয় প্রণোদনা প্রয়োজন হয়, যেমন ক্যাশ-ব্যাক অফার, লয়্যালটি প্রোগ্রাম বা জোরালো মার্কেটিং ক্যাম্পেইন। কিন্তু টাকাপে (TakaPay) খুব সামান্য জনসচেতনতা বা প্রচারণার মাধ্যমে চালু করা হয়েছিল, যা নতুন ব্যবহারকারী আকর্ষণে ব্যর্থ হয়েছে।
সর্বশেষে বলতে হয়, কার্ডটি প্রথমে চালু করা হয়েছিল ম্যাগনেটিক স্ট্রিপ প্রযুক্তি দিয়ে, যা তুলনামূলকভাবে কম নিরাপদ ও পুরনো। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক কার্ডগুলো ইতোমধ্যেই ব্যবহার করছিল উন্নততর ও সুরক্ষিত চিপ-ভিত্তিক EMV স্ট্যান্ডার্ড।
সুতরাং উপরের সমস্যাগুলো সমাধান করলে TakaPay বা বাংলা QR সার্ভিস গুলো জনপ্রিয় হবে এবং লক্ষ লক্ষ ডলার বাংলাদেশ থেকে আর বিদেশে যাবে না।